আস্থা অর্জনের চেয়ে ইসির ঝোঁক বেশি প্রযুক্তিতে




২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ইং
sbit

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের চেয়ে ভোটগ্রহণে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর দিকে বেশি ঝোঁক নির্বাচন কমিশনের (ইসি)।

প্রযুক্তির এ প্রয়োগ করতে গিয়ে বাড়ছে নির্বাচনি ব্যয়ের আকারও। দেশের আর্থিক সংকটের মধ্যে বাড়তি ওই টাকা বরাদ্দ চেয়ে সরকারের কাছে ইতোমধ্যেই একাধিক চিঠি দিয়েছে কমিশন।

সর্বশেষ এক চিঠিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) মেরামত ও আনুষঙ্গিক খাতে বাড়তি এক হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।

এর বাইরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ করা হবে-এমন ধারণা দিয়ে আরেক খাতে চাওয়া হয়েছে ২৫৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

একটি আসনে (১৫০টি কেন্দ্র হিসাবে) ইভিএমে নির্বাচন করতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি ১৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। অপরদিকে কাগজের ব্যালটে ভোটগ্রহণে আসনপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ১৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। ইসি সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, কতটি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হবে এবং কতটি ইভিএম মেরামতে কত টাকা লাগবে-তা সুনির্দিষ্ট জানাতে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

ওই যৌক্তিকতা না দিতে পারায় আগামী অর্থবছরের ইসির বাজেট কত হবে-তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়।

এমন অবস্থায় কতটি আসনে এ মেশিনে ভোটগ্রহণ করা হবে-সেই সিদ্ধান্ত শিগগিরই নিতে যাচ্ছে ইসি। এছাড়া ইভিএমে মেরামত বিষয়ে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সঙ্গে আজ বৈঠকে বসছে ইসি সচিবালয়। 

প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হলে নির্বাচনে অনিয়ম কমবে এবং ফলাফল গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন। যুক্তি হিসাবে ইসি বলছে, ইভিএমে আগের রাতে ভোট দেওয়া যায় না।

এ পদ্ধতিতে একজনের ভোট আরেকজন দিতে না পারায় ভোটকেন্দ্র দখলের প্রবণতা কম থাকে। দ্রুত ফলাফল ঘোষণা করা যায়। তবে নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। সংলাপেও এ বিষয়টি উঠে এসেছে। তারা বলেন, নির্বাচনে সব দল অংশ নিলে এবং ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হলে সেটিই বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, সব দলকে নির্বাচনে আনতে নির্বাচনের কমিশনের কোনো উদ্যোগেই দেখা যাচ্ছে না।

তারা কেন ইভিএমের মতো বিতর্কিত মেশিনের প্রতি এত আগ্রহী তা বোধগম্য নয়। সব দল নির্বাচনে অংশ না নিলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং দেশে বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। 

ইসি ও অর্থ মন্ত্রণালয় মধ্যকার বৈঠকের কার্যপত্রে দেখা গেছে, আগামী অর্থবছরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তিনশ আসন, সাড়ে চারশ উপজেলা পরিষদ, দুটি সিটি করপোরেশন, ২০টি পৌরসভা ও ১০০টি ইউনিয়ন পরিষদে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

একই অর্থবছরে জাতীয় সংসদের ১৫টি আসনের উপনির্বাচনও ধরা হয়েছে। সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যথাসম্ভব ইভিএম ব্যবহার করা হবে। এ কারণে নির্বাচনে ব্যয় বাড়তি ধরা হয়েছে।

প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজনে গড়ে ৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা, উপজেলায় দুই কোটি ২০ লাখ টাকা, পৌরসভায় ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং ইউনিয়ন পরিষদে ১৭ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ধরা হয়েছে।

সবমিলিয়ে শুধু নির্বাচন আয়োজনে ২৩৮৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এছাড়া ইভিএম মেরামতের জন্য ‘মেরামত ও সংরক্ষণ’ খাতে প্রথমে এক কোটি ৭২ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হলেও সেটি বাড়িয়ে এক হাজার ২৬১ কোটি ৬২ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে।

মেশিন ও সরঞ্জামাদির ভাড়া খাতে (সিসি ক্যামেরা) ১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকার প্রস্তাব বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা চেয়েছে নির্বাচন কমিশন। সার্বিকভাবে আগামী অর্থবছরে ইসি ৫৪৮৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়েছে।

যদিও নির্বাচন কমিশনের জন্য আগামী অর্থবছরে ১৬২৭ কোটি ৬ লাখ টাকার সিলিং বেঁধে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

নির্বাচনে প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে বাড়তি ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, ইসির কর্মপরিকল্পনা বলা আছে নির্বাচনে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হবে।

প্রযুক্তির ব্যবহার করতে গেলে বাড়তি ব্যয় হবেই। তিনি জানান, আগামী অর্থবছরে ইসি যে বাজেট চেয়েছে তা এখনো চূড়ান্ত নয়। কত আসনে ইভিএম ব্যবহার হবে, কতটি ইভিএম মেরামত করা হবে-এ ধরনের অনেক বিষয়ের ওপর এ টাকার অঙ্ক নির্ভর করছে। নির্বাচন কমিশন কত আসনে এ মেশিন ব্যবহার করবে-সেই সিদ্ধান্ত দিলে তখন কত টাকা লাগবে তা নির্দিষ্টভাবে বলা যাবে। 

নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ ধরা হচ্ছে। এর বড় কারণ হচ্ছে ওই নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়।

এবার ইভিএম ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া ইভিএম মেরামতে বড় অঙ্কের টাকা ধরা হয়েছে। এছাড়া গত পাঁচ বছরে জ্বালানি তেলের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খোরাকি ভাতা বেড়েছে ৭০ শতাংশ। 

নির্বাচনের আগেই আয়ুষ্কাল শেষ ইভিএমের : ইসি সূত্র জানায়, ইভিএমের ক্রয় চুক্তিতে এ মেশিনের ওয়ারেন্টি ও আয়ুষ্কাল পাঁচ বছর ধরা হয়েছে। ২০১৮ সালে দেড় লাখ ইভিএম সংগ্রহ করেছে ইসি।

এ হিসাবে আগামী নির্বাচনের আগেই এ মেশিনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে সবগুলোই মেরামত করার প্রয়োজন হবে বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি।

ওই মেরামতের জন্য ১২৫৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা চেয়েছে বিএমটিএফ। যদিও ইভিএম প্রকল্পের আওতায় এসব মেশিন মেরামতের জন্য আগামী অর্থবছরে ৪০ টাকা ধরা হয়েছিল।

এছাড়া সংরক্ষণ বাবদ গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ভাড়া এসেছে ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সেই টাকাও পরিশোধ করেনি ইসি। বিএমটিএফ কর্তৃপক্ষ বারবারই ওই টাকা পরিশোধের জন্য বলে আসছে। 

সূত্র আরও জানায়, প্রতিটি ইভিএম মেরামতে কত টাকা ব্যয় হবে তা নির্ধারণে আজ বিএমটিএফ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে ইসি। ওই বৈঠকে ব্যয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনও কত আসনে এ মেশিন ব্যবহার করবে সেই সিদ্ধান্তের ওপরও নির্বাচনের ব্যয় কমবেশি হবে।